তৈয়বুর রহমান কিশোর, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি :
জীবন বাজি রেখে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, নিজেরাও পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ। মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। নিয়মিত ভাতাও পাচ্ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে অজ্ঞাত কারণে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তার বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করে ভাতা চালু করতে না পেরে সরনাপর্ন হন উচ্চ আদালতের। ভাতা পাওয়ার জন্য রিট আবেদন করেন তিনি। আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেন। আদালত আদেশ দেন ১৫ সালে যেখান থেকে ভাতা বন্ধ হয়েছে সেখান (জুলাই মাস) থেকেই ভাতা চালু করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত চালু হয়নি তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। ভাতা চালুর
জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। মানুষের সহযোগিতা আর চেয়ে পরিবার নিয়ে দিন যাপন করছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্নু মিয়া! প্রধানমন্ত্রীর
হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের চন্দনী গ্রামের মৃত আবুল হোসেন মিয়ার ছেলে মো. মানিক মিয়া (ওরফে মুন্নু মিয়া) । তিনি ১৯৬৯ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলায় পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। এ বিষয়ে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. জামিল হাসান (বিপি নং-৭১০১১১৬৪৫৮) ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের ক্যান্ডিডেট রেজিস্টার অনুযায়ী এই মুক্তিযোদ্ধা মুন্নু মিয়ার সিরিয়াল নম্বর ১০৬। এরপর তিনি রাজশাহী ইপিপিআর (পুলিশ লাইনে) এ যোগদান করেন। যার নং কনস্টবল/৩২২ (রাজশাহী)। রাজশাহীতে পুলিশে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালে ২৪ মার্চ তিনি সম্মিলিতভাবে রাজশাহী পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫শে মার্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যান্যের সকলের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে
থাকেন। ২৪ শে মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত রাজশাহী পুলিশ লাইনে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন তিনি। পরবর্তীতে পাকিস্তানী আর্মিরা রাজশাহী
পুলিশ লাইন দখল করে নিলে পালিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে চলে যান সে। সেখান থেকে কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে ১নং সেক্টরে যোগদান করেন মুন্নু মিয়া। সেখান থেকে ১০ নভেম্বর জেনারেল উসমানি কমান্ড সার্টিফিকেট দিয়ে ভোলারহাট থানার জোনাল অফিসার মালদহের নিকট রিপোর্ট করার নির্দেশ দেন ও ২৭ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ থানায় বদলি করেন। শিবগঞ্জ থানায় কর্মরত থাকাকালিন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্য যে জেলায় কর্মরত ছিলেন সে জেলায় পুনরায় চাকরিতে যোগদান করবেন। ওই ঘোষণার পর মুন্নু
মিয়া ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহি পুলিশ লাইনে পুনরায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে রাজশাহী জেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় ঠিকমতো বেতন-ভাতা না পাওয়ার কারণে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে চলে আসেন তিনি। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স স্মারক নম্বর কল্যাণ/৬-৯৮/১৯৯০ (১০০), তারিখ ১১.০৭.৯৯ খ্রি. এর ২০ পাতায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মুন্নু মিয়ার নাম অন্তভুক্ত রয়েছে বলে পুলিশের এআইজি (কল্যাণ) মো. হুমায়ুন কবীর প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। একই বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান ২০০১ সালের ১২ অক্টোবর একটি সনদপত্র দিয়েছেন তাকে। ‘‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা গ্রন্থে’’ ২য় খন্ডে ৭০৯ নম্বর পাতায় রাজশাহী জেলার কনস্টবল/৩২২ মানিক মিয়া ওরফে মুন্নু মিয়ার নাম অন্তভুক্ত আছে বলে ২০১৫ সালের ১৫ই এপ্রিল রাজশাহী পুলিশ সুপার মো.আলমগীর কবীর প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধা
সম্মানী ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে মানিক মিয়া ওরফে মুন্নু মিয়া উচ্চ আদালতে রিট করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং
বিচারপতি রাজিক আল জলিল ২০১৬ সালের ১২ জুলাই মুন্নু মিয়ার পক্ষে রায় দেন। রায়ে ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে বকেয়া ভাতাসহ চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিবাদিদের। হাইকোর্টের রায় নম্বর ২০৮৫/২০১৬। রায়ের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম অন্তভুক্ত করন ও সনদ প্রত্যায়নের জন্য গত ২০২০ সালের ১৫ই অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগ পুলিশ শাখা-২ এর উপ-সচিব ফারজানা জেসমিন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে গত ২০২০ সালের ১৫ই অক্টোবর পত্র প্রেরণ করেন। যার স্মারক নম্বর ৪৪.০০.০০০০.০৯৫.১১.০০৫.১৯.৪১৬। এর পরও মুন্নু মিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা চালু হয়নি। দৈনিক আমার সংবাদকে সোমবার মুন্নু মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এমএজি ওসমানি কর্তৃক প্রদত্ত সনদপত্র রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা গ্রন্থেও আমার নাম রয়েছে। সে অনুযায়ী আমি মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাই এবং ভাতা পেতে শুরু করি। ৩০০ টাকা থেকে আমি ভাতা পাওয়া শুরু করি। সর্বশেষ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা পেয়েছি। ভাতা বই নং ১৫০। সোনালী ব্যাংক বোয়ালমারী শাখায় আমার হিসাব নং ৩৪০৯৬৫৭৪। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে আমার ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাই কোর্টে রীট আবেদন করলে হাই কোর্ট ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে আমার বকেয়াসহ ভাতা প্রদানের জন্য
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের সচিবকে নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী সকল কাগজপত্র দিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে ভাতা প্রদান করার জন্য আবেদন পেশ করি।
কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার ভাতা চালু হয়নি। এক সময় উপজেলা পরিষদে নাইট গার্ড হিসেবে চাকরী করতাম কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে সে কাজ আর করতে পারি না। বর্তমানে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য চেয়ে খেয়ে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। এ বিষয়ে আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তিনি আরো বলেন, আমার একটি চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। আয় উপার্জন না করতে পেরে অনেক সময় না খেয়েও দিন কাটাতে হয়। তার তিন মেয়ে বড় মেয়েটি বিয়ে দিয়েছেন। মুন্নু মিয়া বলেন, এই দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। আমার সাথে অনেকেই যুদ্ধ করার সময় মারা গেছে। অথচ আজ আমি না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা প্রকাশ বিশ্বাস রায়ের কপি দেখে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গেজেটভূক্ত করে নির্দেশনা দিলেই তিনি ভাতা চালু করে দিবেন। বোয়ালমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক আব্দুর রশিদ বলেন, তিনি মুন্নু মিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। সে একজন বীর ম্ুিক্তযোদ্ধা এবং বর্তমানে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে। দ্রুত মুন্নু মিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু করার জোর দাবি জানান তিনি।