আমি সব সময় বৃষ্টিতে হাঁটতে পছন্দ করি, তাই কেউ আমার অশ্রু দেখতে পায় না।’ উক্তিটি কৌতুকভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের। পর্দায় তার উপস্থিতি দেখে বোঝা মুশকিল মানুষটি আড়ালে কত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছেন। তিনি পর্দায় নির্বাক হয়ে হাসাতে হাসাতে বিদ্রোহ আর সংগ্রামের গল্প বলেছেন। চার্লির বাবা-মা দুজনই থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। চার্লির বাবা ছিলেন মদ্যপ। মারধর আর অ্যাবিউস করতেন ছোট চার্লিকে। মাতাল বাবার অত্যাচার, বাবার ছেড়ে চলে যাওয়া, মা- ছেলের জীবনে টিকে থাকতে ভিক্ষার পথ বেছে নেওয়াসহ শৈশবের অনেক দুর্বিষহ স্মৃতি জমা আছে তার। ভাগ্যক্রমে সুযোগ হলো প্রথমবার অভিনয় করার সেটিও আবার মাতালের ভূমিকায়। সফর শুরু হলো আমেরিকার। আমেরিকা ভালোবাসায় বরণ করে নিলো চার্লিকে, ভক্তরা পেলেন আইকনিক চরিত্র ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প’। ছোট গোঁফ, ঘোলাটে ট্রাউজার্স, টাইট কালো জ্যাকেট, একটি ছোট কালো বোলার টুপি এবং একটি বেত সহ নির্বাক কমেডির লোকটি এবং সেই বিখ্যাত পেঙ্গুইন হাঁটার স্টাইল। সময়টা ১৯১৪, ভাগ্য তখন চার্লির সঙ্গে। অভিনয় দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন চার্লি। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের থেকেও বেশি আয় করতেন চার্লি। তখন একাই ৩৪টি সিনেমা নির্মাণ, প্রযোজনা করেছিলেন। তার সিনেমার বিশেষত্ব হলো কমিকের ছলে হাসাতে হাসাতেই প্রতিবাদ করেছেন পুঁজিবাদের। তুলে ধরেছেন বৈষম্য আর বঞ্চনার বাস্তব চিত্র। ‘সিটি লাইট’ সিনেমাটিতে উঁচু সব নির্দশনের ভিড়ে বিপন্ন মানুষের দুঃখের কথা কত অকপটে বলেছেন। এটাও যে প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে তা হাসির ফাঁকে ভাবিয়েছে দর্শকদের। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের প্রতিভা। ‘দ্য গোল্ড রাশ’ এবং ‘দ্য কিড’র মতো শৈল্পিক চলচ্চিত্র দিয়েছেন তিনি। একজন শিল্পী সীমাহীন হয়ে গেলে সমাজ তাকে টেনে ধরে, কষ্ট দেয়। ঠিক এটাই তার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার খ্যাতি আর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে অনেক লোকই ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। স্বৈরশাসক হিটলারকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সিনেমা তৈরি করেছিলেন চার্লি। হিটলারের হাঁটাচলা, চোখের চাহনি, চিৎকার করে বক্তব্য দেওয়া সব কিছুই ব্যঙ্গাত্মকভাবে চ্যাপলিন ফুটিয়ে তুলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ও তার নাৎসি দলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলাকালীন সময় ছবিটি মুক্তি পায়। জার্মান সেনাবাহিনীর দখল করা প্রতিটি দেশে হিটলার এই ছবি নিষিদ্ধ করে দেন। শিল্পায়ন ও পুঁজিবাদী নীতির কারণে শিল্পগুলো শ্রমিককে দাস হিসেবে গণ্য করে। চার্লি তার ‘মডার্ন টাইমস’ মুভিতে শ্রমজীবীদের প্রকৃত দুর্ভোগ তুলে ধরেন। এতে মার্কিন সরকার ক্ষুব্ধ হন। যুক্তরাষ্ট্র চ্যাপলিনকে কমিউনিস্ট বলে আখ্যা দেয়। তিনি বরাবরই অস্বীকার করেন যে তিনি একজন কমিউনিস্ট। লোকেরা চ্যাপলিনকে বহিরাগত এবং আমেরিকা বিরোধী বলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তিনি যখন ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন তখন মার্কিন সরকার তাকে আমেরিকা থেকে নির্বাসিত করে দেয়। তাকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না। বরং যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে তাকে নৈতিকতা সম্পর্কিত একটি কমিটির সামনে হাজিরা দিতে হবে জানায় মনে আঘাত পেয়েছিলেন চার্লি। এরপর তিনি চলে চান সুইজারল্যান্ডে। পরবর্তী ২০ বছর তিনি সুইজারল্যান্ডে কাটিয়েছেন। সত্তর-এর দশক থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক আবহাওয়া বদলে যেতে শুরু করলে মার্কিন চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চার্লি চ্যাপলিনকে অস্কার পুরষ্কার দেয়া হয়। দুই দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে চ্যাপলিন পা রাখেন। তিনি ১৯৭৭ সালে বছরের সবচেয়ে আনন্দের দিন, বড়দিনে মারা যান। একজন মহান শিল্পী কখনই তার শিল্পের উর্ধ্বে ব্যক্তিগত সংগ্রাম, রাজনৈতিক চাপ, এমনকি জনগণের সমর্থনের কথা চিন্তা করেন না। মহান শিল্পীরা বহু শতাব্দী ধরে বেঁচে থাকেন। তাদের শরীর মরতে পারে কিন্তু তাদের শিল্প নয় সেটারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সবর্দা হাস্যোজ্জ্বল, প্রিয় কৌতুকপ্রিয় মানুষ চার্লি চ্যাপলিন।